সরিষা ফুলের মধু বা ক্রীম হানির উপকারিতা

বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় মধু হল সরিষা ফুলের মধু। এই মধু খুবই মিষ্টি। রঙ হবে হালকা হলুদ বর্ণের। তবে এই মধুর সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য, তাই আমাদের অনেকের জানা নেই – আর তা হল, সরিষা ফুলের মধু শীতকালে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই জমে যায়।তাই একে ক্রিম হানি বা জমা মধুও বলা হয়ে থাকে।

মধু খুবই উপকারী একটি প্রাকৃতিক উপাদান। শরীর সুস্থ রাখতে নিয়মিত মধু সেবন করতে পারেন। মধুতে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ নামের দুই ধরনের সুগার থাকে। সুক্রোজ ও মলটোজও থাকে অল্প পরিমাণে। এছাড়াও সরিষা ফুলের মধুতে রয়েছে নানাবিধ স্বাস্থ্য উপকারিতা। যেমনঃ

সর্দি-কাশিতে : শীতে সর্দি-কাশিতে ভোগা যেন একটি সাধারণ সমস্যা। নিয়মিত মধু সেবনে ঠান্ডা কাশি দূর হয়।

গলার স্বর ভাঙ্গা : শীতকালে গলার স্বর ভেঙ্গে যায় অনেকের। এই সমস্যায় প্রতিদিন সকালে এক চামচ মধু কুসুম গরম পানিতে মিশিয়ে পান করুন। উপকার পাবেন।

শক্তিবৃদ্ধি : শারীরিক দুর্বলতায় যারা ভুগছেন তাদের জন্যও মধু উপকারী। প্রতিদিন এক গ্লাস গরম দুধে দুই থেকে তিন চা চামচ মধু মিশিয়ে পান করুন। শরীরে শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

হূদরোগে : নিয়মিত মধু সেবন হৃদরোগ প্রতিরোধ করে। রক্তনালি প্রসারণের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে ।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর : যারা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছেন তারা মধু সেবনে উপকার পাবেন।

এছাড়াও সরিষা ফুলের মধুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি। এই মধু একেবারেই কোলেস্টেরলমুক্ত। বিশেষ করে মধু রোগ প্রতিরোধ শক্তি বৃদ্ধি, হার্ট শক্তিশালী, কোষ্ঠকাঠিন্য ও অনিদ্রা দূর করে। শারীরিক দুর্বলতা দূরসহ পাকস্থলি সুস্থ রাখে।

কেনো Sunnah Corner এর ক্রীম হানি অন্যদের থেকে স্পেশাল?    
    
    - স্বাদ , স্বকীয়তা ও গুণগত মানের নিশ্চয়তা।
    - কোনো কটু গন্ধ নেই।
    - কেমিক্যাল ও প্রিজারভেটিভ মুক্ত।
    - শতভাগ প্রাকৃতিক।

সুগন্ধি বা খুশবো ব্যবহারে ইসলামের বিধান

ইসলামে সুগন্ধি বা খুশবোর ব্যবহার বৈধ। সুগন্ধি বা খুশবোর ব্যবহার ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খুবই প্রিয়। তিনি নিজে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। তাই সুগন্ধি ব্যবহার করা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত। শর্ত হলো শুধু তাতে হারামের কোনো না থাকলেই হলো। সুগন্ধির ব্যবহার সম্পর্কে রয়েছে হাদিসের অনেক বর্ণনা-
– হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়ায় সুগন্ধি আমার কাছে প্রিয় করা হয়েছে আর নামাজের ভেতর রাখা হয়েছে আমার চোখের শীতলতা।’ (নাসাঈ)
– বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কেউ সুগন্ধি উপহার দিলে তিনি তা গ্রহণ করতেন, ফিরিয়ে দিতেন না। আবার কেউ সুগন্ধি দিলে ফিরিয়ে দিতেও তিনি নিষেধ করেছেন।’ (বুখারি)
– রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ১০ বছরের খাদেম হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুরভির চেয়ে হৃদয়কাড়া কোনো ঘ্রাণ (অন্য কোথাও) কখনো গ্রহণ করিনি।’ (মুসলিম)

সুগন্ধিযুক্ত স্প্রে সম্পর্কে সচেতনতা
বডি স্প্রেতেও রয়েছে সুগন্ধি। এ সব সুগন্ধি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ সুগন্ধির মধ্যে যদি অ্যালকোহল মাত্রাতিরিক্ত থাকে বা সুগন্ধি যদি অ্যালকোহলের কারণে মাত্রাতিরিক্ত ঝাঝালো হয় তবে তা ব্যবহার বৈধ হবে না।
কেননা যেসব অ্যালকোহল আঙুর, খেজুর অথবা কিশমিশ থেকে তৈরি সেসব অ্যালকোহল সম্পূর্ণ হারাম। এ ধরনের অ্যালকোহল মেশানো সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। হাদিসে এসেছে-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘নেশা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বস্তুই হারাম।’ (বুখারি)
তবে এ তিন উপাদান ছাড়া যেসব অ্যালকোহল বিভিন্ন শস্যদানা, গাছের ছাল, মধু, যব, আনারসের রস, গন্ধক, সালফেট ও অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান থেকে তৈরি তা নাপাক নয়। সুগন্ধিযুক্ত বডি স্প্রে বা যে কোনো সুগন্ধিতে যদি তা এমন পরিমাণ মেশানো হয় যা নেশার সৃষ্টির করে না তবে তা ব্যবহার বৈধ।

শুধু সুগন্ধিযুক্ত বডি স্প্রে বা আতরই নয়, সুগন্ধিযুক্ত সাবানসহ যে কোনো পারফিউমের ক্ষেত্রেই এ বিষয়টি প্রযোজ্য। অর্থাৎ নেশার সৃষ্টি করে না বা বা শারীরিক বা মস্তিষ্কের মতিভ্রমের মতো কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় না। এমন পরিমাণ অ্যালকোহলসমৃদ্ধ সুগন্ধি ব্যবহার করে নামাজসহ অন্যান্য ইবাদত করা যাবে। আর তা ব্যবহার করা বৈধ।

ইসলামিক স্কলারদের মতামত হলো- ‘পরিমাণে একেবারেই কম অ্যালকোহলযুক্ত স্প্রে, সুগন্ধি বা সাবান ব্যবহার করা বৈধ। কারণ, যে পারফিউম, স্প্রে বা আতর ব্যবহার করা হয়, তা শুধু সুঘ্রাণের জন্য, তা তো নেশা করার জন্য অ্যালকোহল ব্যবহার নয়।

তাছাড়া যে কোনো সুগন্ধিযুক্ত স্প্রে, আতর বা পারফিউম ব্যবহারের উদ্দেশ্য হলো দুর্গন্ধ থেকে মুক্ত থাকা। এ সম্পর্কে ইসলামিক স্কলারদের বক্তব্য হলো- কোনো জিনিস যে উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে আর সেটি তৈরির উপাদানে যদি বিচ্ছিন্ন কিছু না থাকে তবে তা ব্যবহারে ইসলামি শরিয়তে বাধা নেই বরং তা ব্যবহার বৈধ।

বডি স্প্রেসহ যে কোনো পারফিউম বা আতর যদি মাত্রারিক্ত অ্যালকোহল দিয়ে তৈরি করা হয়। আর তার ঘ্রাণে মানুষ নেশাগ্রস্ত হয় তবে তা ব্যবহার বৈধ হবে না।

আবার সুগন্ধি বা খুশবোতে যদি এমন কোনো হারাম বস্তু মিশ্রিত হয়, আর তা মিশ্রিত করার আগে ওই জিনিসকে এমনভাবে প্রসেসিং করে যে, হারাম বস্তুটির মৌলিকত্ব বিদ্যমান থাকে না তবে তা ব্যবহার করা বৈধ। যদি সুগন্ধিতে সে হারাম বস্তুর মৌলিকত্ব থাকে তবে তা ব্যবহার করা বৈধ নয়।

আর যদি হারাম বস্তু মিশ্রিত করা হয়েছে কিনা, তা জানা না থাকে তাহলেও ওই পারফিউম, স্প্রে ব্যবহারেও কোনো সমস্যা নেই বলে উল্লেখ করেছেন অনেক ইসলামিক স্কলার।

সুতরাং হাদিসে ঘোষিত ৩ ধরনের অ্যালকোহল সমৃদ্ধ কোনো সুগন্ধি ব্যবহার না করে অন্যান্য বৈধ পন্থায় তৈরি সুগন্ধি ব্যবহার করে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাত তথা আদর্শের অনুসরণ করা উচিত।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সুগন্ধি ব্যবহারের সুন্নাতের অনুসরণ ও অনুকরণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সম্পূর্ণ হালাল সকল আতর বা সুগন্ধীর দাম জানতে অথবা কিনতে ভিজিট করুন সুন্নাহ্ কর্ণার.কম এ।

যেই রুমে কুরআনগ্রন্থ রাখা আছে সেই রুমে স্ত্রী সহবাস করা

প্রশ্ন: যেই রুমে কুরআন রাখা আছে সেই রুমে স্ত্রী সহবাস করার হুকুম কি? যেহেতু অন্য কোন রুম নেই। এটি কি কুরআনকে অপমান করা গণ্য হবে?

উত্তর:

আলহামদু লিল্লাহ।.

এক:

কুরআনকে সম্মান করা ও সংরক্ষণ করা আবশ্যক হওয়ার ব্যাপারে আলেমদের মাঝে কোন মতভেদ নেই।

ইমাম নববী বলেন: “আলেমগণ কুরআনগ্রন্থকে সংরক্ষণ করা ও সম্মান করার ব্যাপারে সর্বসম্মতভাবে একমত।”[আল-মাজমু (২/৮৫)]

দুই:

আলেমগণ এমন কিছু অবস্থা উল্লেখ করেছেন যেগুলোতে কুরআনের অপমান হয়; যেমন:

কুরআনকে মাটিতে ফেলে রাখা কিংবা নাপাক জায়গায় ফেলে রাখা কিংবা কুরআনকে পা দিয়ে মাড়ানো কিংবা কুরআনের উপর থুথু ফেলা… ইত্যাদি যে অবস্থাগুলো আল্লাহ্‌র বাণীকে অপমান করার প্রমাণবহ।

এ অবস্থাগুলোর মধ্যে যে রুমে কুরআনগ্রন্থ রাখা আছে সেই রুমে স্ত্রী সহবাস করার অবস্থাটি নেই; চাই কারো অন্য কোন রুম থাকুক কিংবা না থাকুক।

উল্লেখ্য, অধিকাংশ মুসলমানদের ঘরে কুরআনগ্রন্থ থাকে। আলেমদের যতগুলো কিতাব দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে এতে আমরা আলেমদের এমন কোন কথা পাইনি যে, যেই রুমে কুরআনগ্রন্থ আছে সেই রুমে স্ত্রী সহবাস করা যাবে না। যদি এমন কিছু হত তাহলে অবশ্যই তারা তাদের গ্রন্থসমূহে সেটি উল্লেখ করতেন ও বর্ণনা করতেন; যেমনিভাবে তারা অন্যান্য বিষয়গুলো উল্লেখ করেছেন। যেহেতু তারা এমন কিছু বা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু উল্লেখ করেননি সুতরাং এটি মূল (জায়েয) অবস্থাকে আঁকড়ে ধরা ও মূলের উপর বহাল থাকার প্রমাণ বহন করে।

এক ব্যক্তি ইবনে আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করেছিল”: আমি যে বিছানায় স্ত্রীকে সহবাস করি সেই বিছানার উপর মুসহাফ (কুরআনগ্রন্থ) রাখতে পারব? তিনি বললেন: হ্যাঁ।”[এই উক্তিটি আব্দুর রাজ্জাক তাঁর মুসান্নাফ নামক গ্রন্থে (২/১৭১) বর্ণনা করেছেন এবং ইবনে আবু দাউদ আল-মাসাহিফ নামক গ্রন্থে (৪৪৬) বর্ণনা করেছেন]

পড়ুন: আব্দুল্লাহ্‌ ইউসুফ আল-জুদাঈ এর লিখিত: আল-মুকাদ্দিমাত আল-আসাসিয়্যাহ ফি উলুমিল কুরআন; পৃষ্ঠা- ৫৬২ ও তৎ পরবর্তী।

স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে প্রশ্নকারীর মাসয়ালাটির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ একটি মাসয়ালা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: “বেড রুমে কুরআন ঢুকানো, ঘুমানোর আগে বিছানায় কুরআন পড়া ও একটি লোহার বক্সের ভেতরে বেড রুমে কুরআন রাখা কি জায়েয?

জবাবে তারা বলেন: কুরআনে কারীম বেড রুমে ও বিছানার উপর পড়া জায়েয; যদি ব্যক্তি জুনুবী (সহবাস উত্তর গোসল ফরয হওয়ার অবস্থা) না হয় এবং মুসহাফ থেকে পড়াকালে ওযু অবস্থায় থাকে।”[সমাপ্ত]

যদি বেড রুমে মুসহাফ রাখা হারাম হত; অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর মিলন যেই রুমে সংঘটিত হয়ে থাকে; তাহলে আলেমগণ সেটা উল্লেখ করতেন এবং সেটি এড়িয়ে যেতেন না। যেহেতু এটি প্রায়শঃ ঘটে এবং এটি মানুষের জানা প্রয়োজন।

আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

আপনার মানসিক অস্থিরতার ওষুধ

সুখী হওয়ার, স্ট্রেস কমানোর এবং একটা চাপ-বিহীন জীবন যাপনের জন্য যা সবচেয়ে বেশি দরকারি তা হলো— মানুষের ওপর থেকে প্রত্যাশার পারদটাকে যতোটা সম্ভব কমিয়ে আনা। আপনার প্রত্যাশা যতো স্বল্প, ব্যস্ততা এবং অস্থিরতাও ততো কম। প্রত্যাশা যতো বাড়ে, সত্যিকার অর্থে আপনার ব্যস্ততা এবং অস্থিরতাও ততো বেড়ে যায়।

একেবারে বাস্তব জীবনের উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। বছর দুয়েক আগে একজন মানুষের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয় এবং তিনি আমার লেখক পরিচয়টাও জানতেন। যেহেতু আমার লেখক পরিচয়টা তিনি জানেন এবং আকারে-ইঙ্গিতে বুঝাতে চান যে তিনি আমার গুণমুগ্ধ পাঠক, ফলে আমি আশা করেছিলাম, আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি কী গদগদ-ই না হবেন!

আমার সাথে সাক্ষাৎ করে তিনি যারপরনাই খুশি যদিও হয়েছিলেন, কিন্তু একেবারে আত্মহারা হয়ে যাবে বলে আমার অবচেতন মন যে কল্পনা করেছিলো, সেরকমটা না হওয়াতে আমি ভীষণ কষ্ট পাই সেদিন। বেশ অস্থির লাগা শুরু করে ভিতরে ভিতরে। মনে হতে লাগলো— ‘ধুর, দেখা না করলেই ভালো ছিলো’।

অন্য আরেকটা আড্ডার কথা বলি। ওই আড্ডায় বইয়ের জগতের বেশ গণ্যমান্য কতিপয় ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎ হয় আমার, কিন্তু তাদের আমি জানতে দিইনি যে আমি লেখক আরিফ আজাদ। যতোটুকু আদর-আপ্যায়ন, খাতির করা যায় তার সবটুকুই তাদের কাছ থেকে পেলাম। সেবার আমার একটুও মন খারাপ হয়নি এবং খানিক অস্থিরতাও ভর করতে পারেনি অন্তরে। একটাবারের জন্যও মনে হয়নি যে— আমি যে সম্মানের প্রাপ্য, তা ওরা আমাকে দিলো না।

প্রথম ঘটনায় আমি শয়তানের ওয়াসওয়াসার শিকার নিঃসন্দেহে। সে আমাকে ফুসলিয়ে বলেছে— ‘দেখো, তুমি কতোবড় একজন লেখক! হাজার হাজার মানুষ তোমাকে একনজর দেখবার জন্যে মরিয়া, আর এই লোক কি-না তোমাকে দেখে একটুও বিস্মিত হলো না, আবেগে আত্মহারা হলো না! কী আণ্ডারেস্টিমেইটটাই না লোকটা তোমাকে করলো!’

শয়তানের এই ওয়াসওয়াসা আমার ভিতরে একটা আত্ম-অহমিকার বুদ্বুদকে জাগিয়ে দিলো এবং আমি তাতে বিভ্রান্ত হয়ে বিশ্বাস করে নিলাম যে— সত্যই তো, আমাকে দেখে তো আনন্দে তার আটখানা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কী সাদামাটা অভ্যর্থনাই না পেলাম! এটা আমার সম্মানের সাথে আদৌ যায়?’

এই ওয়াসওয়াসা আমাকে দুটো ব্যামোর দিকে ঠেলে দিলো:

১. অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা

২. মানসিক অস্থিরতা

এর কারণ কী জানেন? প্রথম ঘটনায় আমার প্রত্যাশার পারদ ছিলো হিমালয় ছোঁয়া। কিন্তু হিমালয়ের বিপরীতে যখন প্রাপ্তির খাতায় মিললো তাজিংডং পর্বত, তখন তো খারাপ লাগা আর অস্থিরতা বাড়বেই। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় আমার প্রত্যাশার পারদ একেবারে নিম্নমুখী। হিমালয় কিংবা তাজিংডং নয়, দাঁড়াবার জন্য পায়ের নিচে একটু খড়কুটো পেলেই আমি বেজায় খুশি। দ্বিতীয় ঘটনার লোকেরা যেহেতু জানতো না আমার সত্যিকার পরিচয়, সুতরাং তখন তাদের কাছে আমি একেবারে সাধারণ এক অতিথি। সেখানে আমি যা পাই, তাতেই বিলকুল আনন্দিত। যেহেতু ‘আরিফ আজাদ’ হিশেবে তাদের সামনে আমি যাইনি, তাই শয়তানও আমাকে ওয়াসওয়াসা দেওয়ার রাস্তা খুঁজে পেলো না। সে আমাকে বোঝাতে পারলো না— ‘দেখলে, তোমার মতো এতোবড় পাবলিক ফিগারকে তারা কি-না একেবারে সাদামাটা আয়োজনে বিদেয় করেছে!’

আমাকে এই ওয়াসওয়াসা দেওয়ার কোন রসদ শয়তানকে আমি দিইনি। ফলে সে আমার প্রত্যাশার পারদ বাড়াতে পারেনি। যেহেতু প্রত্যাশা একেবারে কম ছিলো, তাদের হাসিমুখে কথা বলাটাও আমার কাছে তখন বাড়তি পাওনা।

শয়তানের ফাঁদ থেকে আমরা কখনোই নিরাপদ নই। সে ডান-বাম, উপর-নিচ সবদিক থেকে আমাদের দিকে ধেয়ে আসে প্রতিনিয়ত। শয়তানকে ওয়াসওয়াসা দেওয়ার রাস্তা খুলে দিয়ে যদি আপনি তার বিরুদ্ধে ঢাল-তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামেন, আপনার পরাজয়ের সম্ভাবনা শতভাগ। কারণ, শত্রুকে আপন ঢেরায় ঢুকতে দেওয়াটা বুদ্ধিমান বীরের কাজ নয়। তাকে পরাস্ত করতে হলে যে পথে, যে জিনিস দেখিয়ে সে আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে, আপনার অস্ত্র আপনার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে, সেই রাস্তাটাই রুদ্ধ করে দেওয়াটাই যুদ্ধজয়ের অন্যতম কৌশল।

নফসের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেওয়া শয়তানের সবচেয়ে কার্যকরী একটা কৌশল। প্রত্যাশার লাগাম টেনে ধরুন, জীবন থেকে চাপ কমে যাবে।

আমরা রমাদানকে কিভাবে স্বাগত জানাতে পারি

আমরা রমাদানকে কিভাবে স্বাগত জানাতে পারি?

প্রশ্ন: শরিয়ত অনুমোদিত এমন কিছু বিশেষ বিষয় কি আছে যা দিয়ে একজন মুসলিম রমযানকে স্বাগত জানাতে পারে?

উত্তর:

আলহামদুলিল্লাহ।.

মাহে রমযান বছরের সবচেয়ে উত্তম মাস। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা এ মাসে সিয়ামকে ফরয করে, ইসলামের চতুর্থ রুকন বানিয়ে এ মাসকে বিশেষত্ব দিয়েছেন। এ মাসের রাতে কিয়াম পালন করার বিধান জারী করেছেন। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর নির্মিত: এই সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহ্‌র রাসূল (বার্তাবাহক), নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা এবং বায়তুল্লাহ্‌র হজ্জ আদায় করা।”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবপ্রাপ্তির আশায় রমযান মাসে কিয়াম পালন করবে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

রমযান মাসকে স্বাগত জানানোর জন্য বিশেষ কিছু আছে মর্মে আমি জানি না। তবে একজন মুসলিম রমযানকে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সাথে, আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে গ্রহণ করবে; যেহেতু তিনি তাকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন, তাওফিকপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং জীবিতদের মধ্যে রেখেছেন যারা নেক আমলের ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করে। যেহেতু রমযানে উপনীত হতে পারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে একটি মহান নেয়ামত। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে রমযান আগমনের সুসংবাদ দিতেন রমযানের মর্যাদা তুলে ধরার মাধ্যমে এবং আল্লাহ্‌ তাআলা রোযাদার ও নামাযগুজারদের জন্য যে মহান সওয়াব প্রস্তুত রেখেছেন তা বর্ণনা করার মাধ্যমে। শরিয়ত একজন মুসলিমের জন্য অনুমোদন করে যে, তিনি এই মহান মাসটিকে স্বাগত জানাবেন খালিস তাওবার মাধ্যমে, সিয়াম ও কিয়ামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার মাধ্যমে, নেক নিয়ত ও দৃঢ় সংকল্পের সাথে।”[সমাপ্ত]

ফাদিলাতুশ শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায এর “মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত মুতানাওয়্যিয়া”

একই মৃত্যু— অথচ কী ভিন্ন তার রেখাপাত!

[১]

বাংলা ভাষার বেশকিছু শব্দের জঘন্য রকমের বিকৃতি ঘটেছে। সেরকম দুটো শব্দ হলো— দালাল এবং ঘটক। কোনো একটা কাজে যে বা যিনি মধ্যস্থতা করে থাকেন তাকেই দালাল বলা হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য শব্দটার! দালালের অর্থ এখন হয়ে গেছে চাটুকারিতা, তোষামেদি, পদলেহন ইত্যাদি। অর্থাৎ,  নিজের স্বার্থ বজায় রাখতে বা টিকিয়ে রাখতে যে অন্যের চাটুকারিতা করে বেড়ায় তাকে আমরা দালাল বলি। কী সুন্দর একটা শব্দের কী এক জঘন্য পরিণতি!

এরকম আরেকটি শোচনীয় পরিণতি বরণ করেছে ‘ঘটক’ শব্দটি। অবশ্য, দালাল শব্দের মতোন অতোটা পোড়াকপাল তার নয়। ঘটক সেই ব্যক্তি যিনি একটা বিয়েতে বরপক্ষ এবং কনেপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। খুবই ভালো এবং নামদার একটা পেশা বটে!  অথচ, অদৃশ্যমান হলেও শব্দটার সাথে জড়িয়ে গেছে কিছু অপ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার।

কিছু কদর্য ব্যক্তির বাড়াবাড়ি রকম আচরণে ঘটক শব্দ শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে এমন এক চরিত্র, যিনি বেশি কথা বলেন, যিনি যা বলে থাকেন তার অধিকাংশই মিথ্যা, যিনি সবসময় বাড়িয়ে বলেন এবং দিনশেষে এসবের পেছনে তার রয়েছে একটা মোটা স্বার্থ৷ স্বার্থটা কী? সেটা হলো— কোনোমতে বিয়েটা ঘটিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! একটা হাজার টাকার ব্যবসা! এই দুটো শব্দের এহেন জঘন্য পরিণতির জন্য শেষপর্যন্ত যে জীবটি দায়ী তার নাম মানুষ!

সম্প্রতি একটা ‘সফল ঘটকালি’ সম্পন্ন করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, আলহামদুলিল্লাহ।  কনে আমার স্ত্রীর বান্ধবি আর বর আমার বন্ধু মানুষ। দুজনের মধ্যে মেলবন্ধনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাকে মধ্যস্থতাকারী বানিয়েছেন। তাই, প্রসঙ্গক্রমে যখনই কেউ পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘উনিই হচ্ছেন এই বিয়ের ঘটক’, তখন ভারি লজ্জা লাগে। মন উসখুস করে। কী একটা বিশ্রী কান্ড! ভাবি— আমিই ঘটক এই কথা শোনার পর মানুষগুলো আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে? ভাবছে আমি একটা মিথ্যের জাহাজ? ভারি ভারি মিথ্যে কথা আর সাত-পাঁচ বুঝিয়ে দু’পক্ষের মাথা খেয়েছি? টাকার লোভে তাদের আমি আকাশ-পাতাল বুঝিয়েছি? লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়!

ইচ্ছে করে বাংলা অভিধান থেকে ‘ঘটক’ শব্দটাকেই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিই। কিন্তু, ও কাজ তো আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি তো বাংলা ভাষার হর্তাকর্তাদের কেউ নই। আমি যা পারি তা হলো এই শখের ঘটকালি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। তাই ইচ্ছে।

[২]


শখের ঘটকালি করে ফেললাম, অথচ চূড়ান্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো না, তা বোধকরি ভালো ঠেকে না। একে তো বর আমার বন্ধু মানুষ, কনে আমার প্রিয়তমার প্রিয়তম বান্ধবি। তার উপরে আমিই ঘটক। এমন ত্রিশৈল চক্রে বাঁধা পড়ে বিবাহ অনুষ্ঠানে আমাকে আসতেই হলো। ইট-পাথর আর দূষিত বাতাসের শহর ঢাকা ছেড়ে নির্ঝঞ্ঝাট, সবুজ-শ্যামলিমা আর ছায়াঢাকা কুষ্টিয়ার পথে বিয়ের বর সমেৎ রওনা করতে হলো ট্রেনে। ঢাকা টু খুলনার ট্রেন। আমরা নেমে যাবো ভেড়ামারা ষ্টেশানে। পথিমধ্যে অতিক্রম করতে হলো সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ষ্টেশান। ওই ষ্টেশানে আমাদের ট্রেন থামতেই আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ করে চ্যাঁৎ করে উঠলো।

নাহ, এই ষ্টেশান ঘিরে আমার কোন সুখস্মৃতি নেই, তবে শোকস্মৃতি আছে। এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। সপ্তাহও তো হলো না৷ এই এলাকাতেই কী করুণ একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো! মাইক্রো করে বরসহ বরযাত্রী যাচ্ছিলো। ট্রেনের সাথে ধাক্কা লেগে মূহুর্তে ঝরে গেলো কতোগুলো প্রাণ! মারা গেলো বিয়ের বরটাও। আহারে! স্বপ্ন শুরুর আগেই স্বপ্নভঙ্গ!  সূর্যোদয়ের আগেই যেন জীবনে নেমে এলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত সূর্যাস্ত। মৃত্যু কতো সহজ! কতো নিকট!

ভাবছিলাম— আমিও তো বরযাত্রী যাচ্ছি। আমার সাথেও তো এক বর বসে আছে। তার চোখেমুখে স্বপ্নের মাখামাখি। তিনি ভাসছেন এক স্বপ্নের নদীতে। সেই নদীতে ছলাৎ ছলাৎ করে উপচে পড়ছে সুখের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভারি উথলা তার মন। ঢেউয়ের পরতে পরতে স্বপ্নের গাঁথুনি। বাতাসে সুখের ঝনঝনানি।


আচ্ছা, যদি আজ আমাদের সাথেও ঘটে যায় সেদিনকার মতোন কোন ঘটনা? যদি কোন দূর্ঘটনায় স্বপ্নভঙ্গ হয় সকলের? যদি শোনা যায় বগিচ্যুত হয়ে পড়েছে আমাদের ট্রেন? যদি চিৎকার-চেঁচামেচিতে আজও ভরে উঠে উল্লাপাড়ার আকাশ? যদি মৃত্যু হয় বরের? যদি মৃত্যু হয় আমার? হতেও তো পারে! এই জগত সংসারের কোনটাই তো মানুষের ইচ্ছের দামে হয় না। যিনি এই জগত সংসারের মালিক, তার ইচ্ছেই তো সব, তাহলে?

আমি কি প্রস্তুত আছি মৃত্যুর জন্যে? সেদিনকার ওই বর কি প্রস্তুত ছিলো? আত্মভোলা এই দেহের উপর যদি মৃত্যু এসে ভর করে? তাহলে কি হবে? নিতান্তই অপ্রস্তুত হয়ে ঢুকে পড়বো এক মহা সমাবেশে? কীসের উপর আমার মৃত্যু হচ্ছে? হাসি-কৌতুক আর ঠাট্টা-তামাশার উপর? গান-বাজনা আর নাফরমানির উপর? অকৃতজ্ঞতা-অবাধ্যতার উপর? সে এক মহাভাবনা!

[৩]

মারা গেছেন হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ। তিনি মারা যাওয়ার সাথে সাথে একটা জিনিস চাউর হয়েছে। গুলশান মদের বারে তার মৃত্যু শোকে আধ ঘন্টার জন্য মদ পান বন্ধ রাখা হয়েছে। হায় কপাল! কী এক মৃত্যু আর তার প্রতি কী এক নিবেদন!

কুষ্টিয়া এসে জানলাম এখান থেকে ঝিনাইদহ একেবারে কাছে। এতো কাছে এলাম, অথচ স্যার খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট দেখবোনা, তা কী করে হয়? এমন সুযোগ হাতছাড়া করি কোন দুঃখে?


বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেই রওনা করলাম ঝিনাইদহ আস-সুন্নাহ ট্রাস্টে। আমার স্যারের নিজের হাতে গড়া ইমারত! আহা, সেই দেওয়াল, সেই মাদ্রাসা, সেই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো! সবকিছুই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নেই সেই মানুষটা! তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিকক্ষণ।  ভাবলাম— শতধা বিভক্ত এই উম্মতকে এক করতে চাওয়া মানুষটা যদি দেখতেন এই উম্মত আরো সহস্র, অযুত-নিযুত দলে ভাগ হয়ে গেছে, তিনি কি আপসোসটাই না করতেন!

এরশাদের মৃত্যুর সংবাদে মদের বারে আধ ঘন্টার জন্য মদ পান বন্ধ ছিলো। আর, স্যার খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভগ্ন হৃদয়ে তার জন্য দোয়া করেনি, হাত তুলে তার মাগফিরাত কামনা করেনি, তাহাজ্জুদে তার নাযাত কামনা করেনি এমন দরদী মুসলমান এই তল্লাটে বিরল হবে। দুটোই মৃত্যু— অথচ মানবহৃদয়ে কী ভিন্ন তার রেখাপাত! 

পইপই করে হিশেব রাখার দিনে

[১]

পইপই করে হিশেব রাখবার একটা চমৎকার সুযোগ এসেছিলো আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সামনে।

দূর সম্পর্কের এক দরিদ্র আত্মীয়কে আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। দারিদ্র‍্যের ভারে নুইয়ে পড়া তার জীবনের অচলাবস্থায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সাহায্যের অন্যতম ভরসাস্থল। কিন্তু, যেবার ‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যাপারে মদীনার মুনাফিকেরা কুৎসা রটালো, চারিত্রিক কালেমার যে অপবাদ তারা লেপ্টে দিতে চেয়েছিলো উম্মুল মুমিনীনের গায়ে, সেই ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলো আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেই আত্মীয়ও।

ভাবুন তো— কারো দুঃখের দিনে আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিয়ে তার পাশে দাঁড়ান, কিন্তু দিনশেষে যদি জানতে পারেন যে সেই লোকটা আপনার মান-ইজ্জতকে দুই পয়সার দাম দেয় না, সুযোগ পেলে আপনার পিঠেও ছুরি চালাতে মরিয়া, আপনার অবস্থা তখন কেমন হবে? আপনি নিশ্চয় অনেক দুঃখ পাবেন। ভাববেন খাল কেটে আপনি হয়তো কুমির আমদানি করেছেন এতোদিন। অথবা, দুধ-কলা দিয়ে পুষে এসেছেন বিষধর কালসাপ। যার জন্য আপনি গলা-পানিতে নামতে রাজি, সে যদি ওই পানিতেই আপনাকে ডুবিয়ে মারতে চায়, আপনার মনোবস্থা তখন কীরুপ হবে? আপনি বলবেন— না! তোমার সাথে আর না। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে।

তাকে এতোদিন যা সাহায্য-সহযোগিতা আপনি করতেন, সব বন্ধ করে দিবেন মুহূর্তেই। আর যাই হোক— একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে আর কোন সম্পর্ক আপনি রাখতে পারেন না।

‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘটনায় দূর সম্পর্কের সেই আত্মীয়ের ব্যাপারেও মুহূর্তের জন্য এভাবে ভেবেছিলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বললেন— ‘নিয়মিতভাবে তোমাকে যে সাহায্য-সহযোগিতা আমি করতাম সেটা আজ থেকে বন্ধ করলাম। আমার কন্যার ব্যাপারে যে লোক এতোটা অপবাদ দিতে পারে, তার জন্য আমার কোন দয়া থাকতে পারে না’।

একজন মানুষ হিশেবে, একজন বাবা হিশেবে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই চিন্তাটা খুব-ই স্বাভাবিক। আপনি বা আমি হলেও এর ব্যতিক্রম চিন্তা কখনোই করতে পারতাম না। কিন্তু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই চিন্তাটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পছন্দ করলেন না। কেউ একজন অন্যায় করেছে বলে, সেই অন্যায়ের পই পই হিশেব করে, তার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক আপনি ছিন্ন করে আসবেন, দুঃসময়ে তাকে দিয়ে আসা সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দিবেন— এমনটা করবার ব্যাপারে ইসলাম আপনাকে উৎসাহিত করে না। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে, তাকে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কুরআনে আয়াত নাযিল করলেন:

‘তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন এবং আল্লাহর পথে হিজরাতকারীদেরকে সাহায্য করবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে ও তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিক? আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।’– আন নূর, আয়াত-২২

আল্লাহ বলছেন— আমাদের মধ্যে যাদের মর্যাদা এবং প্রাচুর্য আছে, আমরা যেন কখনোই আমাদের আত্মীয়স্বজন, দরিদ্র এবং আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারী, আমাদের সাহায্য যাদের অতীব দরকার তাদের যেন আমরা উপেক্ষা না করি। হতে পারে আমাদের কোন বিপদের সময়ে তারা আমাদের পাশে ছিলো না। হতে পারে তাদের জন্যই আমাদের পার করতে হয়েছে কোন ভয়ঙ্কর দুঃসময়। হতে পারে আমাদের সাথে তারা ভারী অন্যায়-অবিচার করেছে কোন সময়। একদিন তাদের কাছে হাত পাতলেও তারা হয়তো আমাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আল্লাহ বলছেন— তাদের সেই অন্যায়ের, তাদের সেই অবিচারের, সেই আত্মকেন্দ্রিকতা এবং হিংসুটে মনোভাবের পইপই হিশেব যেন আমরা করে না রাখি। সেগুলোকে হৃদয়ে টুকে রেখে তাদের দুঃসময়ে যেন আমরা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে না উঠি। আমরা যেন তাদের ক্ষমা করি। তাদের ভুলকে ভুলে গিয়ে, আমাদের দয়া, উদারতা আর প্রশস্ত হৃদয় তাদের যেন তাদের প্রতি নিবেদন করি। এতে কী হবে? আল্লাহ বলছেন— ‘তোমরা কি চাও না আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিক?’

যখন একজনের ভুলকে বড় করে না দেখে তার দুয়ারে দয়ার ঝুঁড়ি নিয়ে উপস্থিত হবো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালাও তার দয়ার ভাণ্ডার আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবেন। যে ক্ষমা করতে পারে তার কোন ক্ষতি নেই, বরং তার জন্য আছে মহা-পুরস্কার।

আয়াতটা নাযিল হওয়ার পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি বললেন— ‘অবশ্যই আমি চাই যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কখনোই আমার ওই আত্মীয়কে দিয়ে আসা সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করবো না’।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পইপই করে হিশেব রাখেননি।

[২]

পইপই করে হিশেব যদি রাখতেই হতো, এই কাজে ইউসুফ আলাইহিস সালামের চাইতে বেশি অগ্রাধিকার আর কে পেতেন দুনিয়ায়?

সেই ছোট্টবেলায় খেলার নাম করে ভাইয়েরা তাঁকে কূপে ফেলে দিয়েছিলো। এরপর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কতো দুঃসময়ের ভেতর দিয়েই না যেতে হয়েছিলো তাঁকে! কিন্তু, একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যখন তাঁকে রাজত্ব দান করলেন, দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করলেন ক্ষমতা দিয়ে, যখন ভাইদের অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার সমস্ত সুযোগ ইউসুফ আলাইহিস সালামের পায়ে লুটোপুটি খেতে লাগলো, তখন ভাইদের উদ্দেশ্য করে তিনি কী বললেন জানেন?

‘আজ তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ যেন তোমাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল’– সুরা ইউসুফ, আয়াত-৯২

পইপই করে হিশেব রাখেননি নবি ইউসুফ আলাইহিস সালাম।

[৩]

একদিন ‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন কোনটা?’

নবিজী বললেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন ছিলো সেটা, যেদিন তায়েফবাসীরা আমার প্রতি নির্দয় হয়েছিলো’।

মক্কাবাসীর অনবরত অনাচার-অত্যাচার আর প্রিয়তম চাচা আবু তালিব এবং প্রিয়তম স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান নবিজী তায়েফে গিয়েছিলেন একবুক আশা নিয়ে। তিনি ভেবেছিলেন— তায়েফবাসীরা মক্কাবাসীর মতো নির্দয় হবে না। হয়তো আল্লাহর দ্বীনকে তারা পরম মমতায় গ্রহণ করবে। কিন্তু, তায়েফবাসীরা তা করেনি। উল্টো নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা এতো ঘৃণ্য আর জঘন্য পর্যায়ের অপমান করলো যে, তাকে রক্তাক্ত করে, পাথরের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে বিতাড়িত করলো তায়েফ থেকে। সেই দিনটা ছিলো নবিজীর জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় দিন।নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন অপমান দেখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পাহাড়ের ফেরেশতাকে আদেশ দিয়ে পাঠালেন। সেই ফেরেশতা এসে নবিজীকে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমি পাহাড়ে নিযুক্ত ফেরেশতা। তায়েফবাসীরা আপনার সাথে যা করলো তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা দেখেছেন। তিনি আমাকে আপনার কাছে আসবার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি যদি চান তাহলে দুই পাহাড়ের চাপে আমি তায়েফবাসীকে পিষ্ট করে ফেলবো এখনই’।

এতো অত্যাচার, এতো নির্যাতন, এতো অপমান! তবু পাহাড়ের ফেরেশতার এই কথার জবাবে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন কী বললেন জানেন? তিনি বললেন, ‘না, আমি তা চাই না। আমি আশা করি একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা এই জনপদে এমন মানুষের আবির্ভাব ঘটাবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করবে’।

নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পইপই করে হিশেব রাখেননি।

[৪]

কী পাচ্ছেন আর কী পাচ্ছেন না, কার কাছে পাচ্ছেন আর কার কাছে পাচ্ছেন না— এসব ভেবে যদি জীবন সাজাতে যান, তাহলে মানুষের ভুলগুলো বড় করে দেখা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর, মানুষের ভুলগুলো, ত্রুটি-অন্যায়গুলো যদি পইপই করে হিশেব করতে শুরু করেন, যদি আজ থেকে সেসব নোট করা শুরু করেন, সেই নোট খাতা একদিন এনসাইক্লোপিডিয়ার সমান হয়ে দাঁড়াবে। চারপাশে আপনি তখন শত্রু ছাড়া আর কিচ্ছু দেখতে পাবেন না। এমন সংকীর্ণ হৃদয় নিয়ে বাঁচবার জন্যে ইসলাম আপনাকে শেখায় না। ইসলাম আপনাকে উদার, মহৎ আর প্রশস্ত হৃদয় বানাতে শেখায়। কে কী দিলো, কে কী করলো— তার ওপর নির্ভর করে আপনি মানুষকে বিচার করবেন না। আপনি মানুষের কাজে লাগবেন, তাদের পাশে দাঁড়াবেন, তাদের বন্ধু হবেন বিনা শর্তে, বিনা-অভিপ্রায়ে।

উহু, ঠিক তা নয়।

অভিপ্রায় তো একটা আপনার থাকাই লাগবে। তো, কী সেটা, তাই তো? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বলছেন:

‘মানুষের কল্যাণ করুন যেভাবে আল্লাহ আপনার কল্যাণ করেন’।– আল ক্বাসাস, আয়াত-৭৭

কে আপনার অকল্যাণ সাধন করলো, কে আপনার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ালো না, কে আপনার পেছনে শত্রুতা করেছিলো— এসবকিছুর জন্যে আপনার জীবন কিন্তু থেমে থাকেনি। সেই অকল্যাণ থেকে, সেই দুঃসময় থেকে, সেই শত্রুতা থেকে কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনাকে ঠিক-ই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। তাই, কারো উপকার করার জন্যে ‘সে আপনার জন্য কী করেছে’ তা বিবেচ্য নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনার জন্যে যা করেন তা-ই বিবেচ্য।

পইপই করে হিশেব রাখুন, তবে তা তাদের দুঃসময়ে তাদেরকে ঘায়েল করবার জন্যে নয়। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বলবার জন্যে যে—‘ইয়া আল্লাহ! আমার দুঃসময়ে আমি তাকে পাশে পাইনি, কিন্তু আপনি ঠিক-ই আমার পাশে ছিলেন। এখন তার দুঃসময়ে আপনি আমাকে তার মতো বানাবেন না। আমার অন্তরকে তার মতো সংকীর্ণ করে দিবেন না। তার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাওফিক আপনি আমাকে দান করুন, ইয়া রব’।

স্বপ্ন সুখের বীজ বুনে যাই

[ক]

প্রিয় একজন ভাই একদিন খুব মন খারাপ করে ম্যাসেজ করলেন। ম্যাসেজে যা জানালেন তা হচ্ছে,- তার ছেলেটা স্কুল থেকে একটা খেলনা কাউকে না জানিয়ে নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, প্রথমে বলেছে এই খেলনা তাকে তার ম্যাম দিয়েছে। পরে বাবা যখন জোর করে সত্যটা জানতে চাইলেন, তখন বললো যে, ও কাউকে না জানিয়েই এই কাজ করেছে। চুরি করে স্কুল থেকে খেলনা বাসায় নিয়ে এসেছে।

ভাইটা প্র্যাকটিসিং মুসলিম এবং ছেলেকে দ্বীনের বুনিয়াদি বলয়ে বড় করে তুলছিলেন বলেই ছেলের এই কাজ তাকে খুব বেশি আহত করেছে। ম্যাসেজে তিনি আরো বললেন, ‘আমার তো ইচ্ছে করছে ওকে একটা আছাড় দিয়ে মেরে ফেলি। ওর ঘরভর্তি খেলনা। তা-ও সে এই কাজ করেছে’।

তিনি আমার কাছে পরামর্শ চাইলেন এখন তার আসলে কি করা উচিত। আমি বললাম, ছেলেকে বকাঝকা করার কোন দরকার নেই। বাচ্চা মানুষ। সে যা করেছে তা যে ‘চুরি’ হতে পারে, সেই বোধ হয়তো তার মাঝে নেই। এই কাজ যে একপ্রকার ‘চুরি’ এবং এটা যে একটা অপরাধ, গুনাহের কাজ, সেই বোধ তার মধ্যে জাগিয়ে দেওয়ার এখনই সুবর্ণ সময়। তাকে কাছে টেনে, সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে হবে যে সে যা করেছে সেটা গুনাহের কাজ। এই কাজের ফলে আল্লাহ তায়ালা তার সাথে রাগ করেছেন। এখন তার উচিত আল্লাহকে বলা, ‘ও আল্লাহ! আপনি আমাকে মাফ করে দিন। আমি ভুল করেছি। আমি আর এরকম করবো না। কখনোই না। আমাকে মাফ করে দিন। প্লিয! প্লিয!’।

[খ]

একবার একটা দেয়ালিকার দুটো লাইনে চোখ আটকে গিয়েছিলো। ওতে লেখা ছিলো-

‘আপনার সন্তানের জন্য সম্পদের পাহাড় রেখে যাবার বদলে তাকেই সম্পদ বানিয়ে যান’।

অসম্ভবরকম শক্তিশালী দুটো লাইন। আমাদের কাছে সন্তানের ভবিষ্যত মানে সন্তানের জন্য ব্যাংক-ব্যালেন্সে কাড়ি কাড়ি টাকা আর বিশাল বিশাল অট্টালিকা গড়ে যাওয়া। এসব করতে পারলেই আমরা ধরে নিই যে আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত উজ্জ্বল এবং নিরাপদ। তাকে অর্থকষ্টে পড়তে হবেনা, অন্নকষ্ট ভোগ করতে হবেনা। পায়ের উপর পা তুলে রাজার হালতে দিন গুজরান হবে তার।

কিন্তু, সন্তানের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়তে গিয়ে সন্তানের দিকে বিশেষ নজর দেবার সময় এবং সুযোগ আমাদের আর হয়ে উঠেনা। ফলে, সন্তানের জন্য জমাকৃত সম্পদের গ্রাফ যতো উর্ধ্বমুখী হয়, আমাদের সন্তানদের নৈতিক মূল্যবোধ হয় ততোই নিম্নমুখী।

সে আজ স্কুল থেকে এর-ওর খেলনা নিয়ে বাসায় ফিরছে, কিন্তু আমি তাকে কিছুই বলিনি। এমনকি, আমি হয়তো এই খবর জানিও না। আজ এর সাথে মারপিট করছে তো কাল স্কুল থেকে পালাচ্ছে। বন্ধুদের ফাঁদে পড়ে শখ করে আজ বিড়ি ফুঁকছে তো কাল সিগারেট, আর পরশু দিন হয়তো হাতে নিচ্ছে কোন ড্রাগ। কিন্তু, সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমরা এতোই ব্যস্ত আর বিভোর যে, সন্তানটার দিকে তাকাবার ফুসরত পর্যন্ত আমাদের নেই। আমার দিন-রাতের পরিশ্রমের টাকা আর সম্পদ যখন সে মদের বারে খরচ করবে, যখন সে আমার রেখে যাওয়া দালানে নারী নিয়ে ফুর্তিতে মেতে উঠবে, বৃদ্ধাবস্থায় যখন সে আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসে তার দায়িত্ব পালন করবে- তখন কি নিজের প্রতি আমাদের একটিবারও আফসোস হবেনা?

আমার শ্বশুরের মুখে শ্বশুরবাড়ির এক লোকের গল্প শুনেছিলাম। ভদ্রলোক খুব কষ্ট করে, একেবারে নিঃস্ব অবস্থা থেকে উঠে এসে এখন এলাকায় ভালো রকমের সহায়-সম্পত্তির মালিক হয়েছে। তার দুটো ছেলে। দুই ছেলেই খুব আদরের সাথে বড় হয়। অন্নদামঙ্গলকাব্যে ইশ্বর পাটনী যেমন বলেছিলেন ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’, একই অবস্থা হয়েছে ছেলে দুটোরও। তারা জন্মের পর থেকেই বাবাকে ‘বড়লোক’ ‘টাকাওয়ালা’ আর ‘বাড়িওয়ালা’ পিতা হিশেবে পেয়ে এসেছে। তাদের জন্মের আগে তাদের পিতার সংগ্রাম আর দূর্দশার চিত্র তারা দেখার সুযোগ পায়নি। ফলতঃ তারা ধরেই নিয়েছে, চাহিবামাত্র তাদের পিতা তাদের সবকিছু দিতে বাধ্য থাকিবেন।

এরপর যা হবার তা-ই হলো। বড় ছেলেটা নেশায় এডিডেক্ট হয়ে পড়ে। তার কোন একটা আবদার বাবা-মা পূরণ না করায় একদিন সে আত্মহত্যা করে বসলো। অন্যটারও হয়েছে একই রোগ। যখন তখন বলে ‘আমাকে এটা দাও-ওটা দাও, নয়তো কিন্তু আমিও ভাইয়ের মতো গলায় ফাঁস দেবো’। বাবা-মা’র হয়েছে জ্বালা! আইফোন চাইলেও দিতে হচ্ছে। নতুন মডেলের বাইক চাইলেও দিতে হচ্ছে। যা চাচ্ছে তাই দিতে হচ্ছে। নয়তো সে তার ভাইয়ের মতোন আত্মহননের পথে হাঁটবে। আদরের অবশিষ্ট পুত্র, যদি মরেই যায় শেষ পর্যন্ত, বাবা-মা তাহলে বাঁচবে কিভাবে দুনিয়ায়? সুতরাং, হয় সন্তানের যন্ত্রণা, নয়তো-বা সন্তানের মরণ-যন্ত্রণা, যেকোন একটা বেছে নিতে হচ্ছে তাদের।

আমরা আমাদের সন্তানদের ভালোবাসি এবং ভালোবাসবো। এই ভালোবাসা সহজাত। কিন্তু, এই ভালোবাসার মানে এটা নয় যে তাকে বেপরোয়া, বেয়াড়া আর উচ্ছৃঙ্খল বানিয়ে ছাড়বো। তার সব কথায়, সব আবদারে সম্মতি জানাবো। সন্তান গড়ার মূল চাবিকাঠি কিন্তু বাবা-মায়ের হাতেই। এটা আকাশ থেকে টুপ করে হাতে এসে পড়া কোন জিনিস নয়, এটা অন্য অনেককিছুর মতো, দীর্ঘ-সংগ্রাম আর ধৈর্যের বিনিময়ে, দুয়ার মাধ্যমে অর্জন করে নিতে হয়। দূর্ভাগ্যবশতঃ জীবনে অনেক স্কিল ডেভেলপমেন্টের দিকে আমাদের দৌঁড়ঝাপ থাকলেওে, সন্তান মানুষ করার মতোন অত্যাবশ্যকীয় গুণ অর্জনের ব্যাপারে আমাদের ততোধিক অনীহা। হতে পারে এটার তাৎক্ষণিক বাজার মূল্য নেই বলে আমরা খুব বেশি পাত্তা এটাকে দিতে চাই না, কিন্তু, এর বিনিময়ে জীবনে যে চরম মূল্য আমাদের গুনতে হয়, তা কখনোই কাগুজে টাকার অঙ্কে পরিমাপযোগ্য নয়।

আবার, আমাদের অনেকে সন্তান মানুষ করা বলতে বুঝে থাকেন সদা-সর্বদা বাবা-মায়ের চোখ রাঙানি, বাচ্চাকে কথায় কথায় ধমক আর ভুল-ত্রুটির জন্য শাস্তি দেওয়া। এগুলো কোনোভাবেই গুড প্যারেন্টিং নয়। সন্তানের সঠিক তারবিয়্যাহ তথা পরিচর্যা হতে হয় ভালোবাসা, সচেতনতা আর সতর্কতার মিশেলে। ছোটবেলায় খাবার টেবিলে খাবার নষ্ট করতে দেখে তাকে চোখ না রাঙিয়ে, ধমক দেওয়ার পরিবর্তে যদি বলি, ‘বাবা, কতো অসহায় মানুষ ওইটুকুন খাবারও খেতে পায় না, তুমি জানো? এভাবে অপচয় করতে নেই, সোনা। যারা অপচয় করে, আমাদের আল্লাহও তাদের পছন্দ করেন না’, আমার এমন ভালোবাসাময় আহ্বান সারাজীবন গেঁথে থাকবে তার অন্তরে। সে-যখনই খাবার নষ্ট করার কথা ভাববে, তখনই তার চোখের সামনে অসহায় মানুষের একটা মুখচ্ছবি ভেসে উঠবে। যখনই বিলাসীতা আর অপব্যয়ের চিন্তা মাথায় আসবে, তার মনে পড়বে আল্লাহর পছন্দ-অপছন্দের কথা। সে নিজেকে সামলাবে, সংযত করবে।

আমাদের ছেলেমেয়েকে আমরা যদি ছোটবেলা থেকে আমানতদারীতা শেখাতে পারি, তাহলে বড় হয়ে সে কখনোই আমাদের সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার আর অপচয় করবেনা। আমার রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে সে হয়তো মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করবে, দান-সাদাকা করবে। আমাদের সম্পদে ভর করে সে কখনোই মদের বার, নাইট ক্লাব কিংবা নিষিদ্ধ পল্লীতে যাতায়াত করবে না। ছোটবেলায় তাকে আমি যা-ই শিখাবো, বড় হয়ে সেগুলোই সে আমাকে ফেরত দিবে।

এমন নয় যে, আমাদের সন্তানের জন্য আমরা কোন সম্পদ রেখে যাবো না। সামর্থ্য থাকলে অবশ্যই তাদের জন্য কিছু করে যাওয়া উচিত। অন্তত, মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু হলেও। তবে, আমাদের সম্পদ, টাকা-পয়সা যেন কোনোভাবেই আমাদের সন্তানদের প্রভাবিত-প্রলোভিত না করে। আমার সম্পদ যেন তার পতনের কারণ হয়ে না উঠে।

[গ]

সূরা লূকমানে ছেলের প্রতি লূকমান আলাইহিস সালামের উপদেশ তথা নাসীহাহগুলো পড়েছেন কখনো? কতো সুন্দরভাবে, মার্জিত শব্দচয়নে তিনি তাঁর সন্তানকে উপদেশ দিয়েছেন! সূরাটি তেরো থেকে ঊনিশ নম্বর আয়াতেই এই উপদেশগুলো সন্নিবেশিত করা আছে। তিনি বলেছেন-

‘প্রিয় পুত্র! আল্লাহর সাথে কখনোই শরীক করো না। আমার সন্তান! (জেনে রাখো পাপ-পূণ্য) যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা যদি পাথর, আসমান কিংবা যমীনের ভিতরেও লুকিয়ে থাকে, তবুও আল্লাহ সেটা (বিচার দিবসের দিন) এনে হাজির করবেন। আমার ছেলে! তুমি সালাত কায়েম করো। সৎকাজে আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ করো। বিপদ আপদে পতিত হলে অবশ্যই ধৈর্যধারণ করবে। নিশ্চয় এটা খুব সাহসিকতার কাজ। আর, কখনোই অহংকারবশঃত মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং যমীনের ওপর দম্ভভরে চলাফেরা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক-অহংকারীকে পছন্দ করেন না। চলাফেরার মধ্যে সংযত ভাব অবলম্বন করবে এবং সর্বদা কন্ঠস্বর নিঁচু রাখবে’।

একজন পিতা কতো উত্তমভাবে, সুন্দর শব্দচয়নে তাঁর সন্তানকে জীবনের দর্শন বাতলে দিচ্ছেন ভাবুন তো। জীবনের সেই দর্শন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালার এতোই পছন্দ হয়ে গেলো যে, তিনি সেগুলোকে কুরআনে স্থান দিয়ে দিলেন। আমরা কি কখনোই এভাবে আমাদের সন্তানদের সাথে কথা বলেছি? তাদের বাতলে দিয়েছি জীবনের এমন দর্শন? চিনিয়ে দিয়েছি জীবনের চলার পথ? হায় আফসোস! ব্যস্ততম কর্পোরেট জীবনে আমাদের সেই ফুসরত কোথায়!

[ঘ]

সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করেছিলেন ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্ললাহ’র মা। সেই নমুনা আমরা দেখতে পাই ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ এবং তাঁর মায়ের মধ্যকার চিঠি চালাচালি থেকে। একবার ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ দ্বীনের কাজে মিশরে আটকা পড়ে যান। যে সময়ে মায়ের কাছে উপস্থিত হবার কথা ছিলো সেই সময়ে তিনি মায়ের কাছে উপস্থিত হতে পারেন নি। সঠিক সময়ে মায়ের কাছে উপস্থিত হতে না পারার দরুন খুবই ব্যথিত হোন তিনি। এই বেদনাবোধ থেকে তিনি মায়ের কাছে একখানা চিঠি পাঠালেন যাতে লেখা ছিলো-

‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। আমার আম্মাজান, আপনার ওপর শান্তি এবং আল্লাহ্‌র রহমত ও নিয়ামত বর্ষিত হোক। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আপনাকে রহম করুন। আপনার দু’চোখকে প্রশান্তি দান করুন। তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর সর্বোত্তম বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করেন, কায়মনোবাক্যে এই প্রার্থনা।

আমরা আল্লাহ তা’য়ালার অগণিত নিয়ামতের জন্য তাঁর প্রশংসা করি। তিনি ব্যতীত ইবাদাতের যোগ্য আর কেউ নেই। সবচেয়ে বেশি প্রশংসা লাভের যোগ্য কেবলমাত্র তিনিই। আমরা প্রার্থনা করি তিনি যেন সর্বশেষ নবী ও মুত্তাকীদের ইমাম মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর তাঁর অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। অবশ্যই আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল এবং প্রতিনিয়ত আমরা তাঁর অসংখ্য অনুগ্রহ পেয়ে ধন্য হচ্ছি। তাঁর অনুগ্রহের জন্য আমরা তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ এবং আমরা দুআ করি যেন তিনি আমাদের উপর তাঁর অনুগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দেন।

আম্মা, আপনি এই-ব্যাপারে অবগত আছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু দায়িত্ব সম্পন্ন করার জন্য আমাকে মিশরে থাকতে হচ্ছে। এই কাজটি এতোই গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি যে, যদি তা যথাযথভাবে সম্পাদন করা না হয়, তাহলে দ্বীন ইসলামের বিকৃতি ঘটার মতো অকল্যাণ ঘটে যেতে পারে।

আল্লাহ্‌র শপথ করে বলছি মা! আমি ইচ্ছা করে আপনার কাছ থেকে দূরে থাকছি না। আকাশের পাখিগুলোর যদি আমাকে বহন করার ক্ষমতা থাকতো, তবে আমি তাতে ভর করে আপনার কাছে চলে আসতাম। কিন্তু মা, আমি যে কেন আসতে পারছি না, তা কেবল আমিই জানি। আপনি যদি এখনকার মিশরের অবস্থা দেখতে পেতেন, তাহলে আপনি আমার এখানে অবস্থান করাটাই পছন্দ করতেন অন্য যেকোন স্থানের চেয়ে।

মা, আমি এখানে ভালো আছি। এখানে আসার পর আল্লাহ্‌ তায়ালা এমনভাবে আমার জন্য তাঁর কল্যাণ, নিয়ামত, দয়াকে প্রশস্ত করে দিয়েছেন এবং এমনভাবে দিকনির্দেশনা দান করছেন যা আমি কোনদিন কল্পনাও করিনি। এখনো কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা বাকি আছে। এগুলোকে অবহেলা করলে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আমাদের কাজের গুরুত্ব বর্ণনাতীত।

মা, আপনার কাছে একটা অনুরোধ, দয়াকরে আল্লাহ্‌র কাছে দুয়া করার সময় আমাকেও আপনি মনে রাখবেন। সবশেষে, অনুগ্রহ করে বাড়ির ছোটবড় সবার কাছে এবং সব বন্ধুর কাছেও আমার সালাম পৌঁছে দেবেন’।

একজন সন্তান মায়ের প্রতি কতোখানি অনুগত হলে, কতোখানি ভক্তি, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা মায়ের জন্য একজন সন্তান বুকের ভিতর ধারণ করলে এমন শব্দচয়নে, এমন গভীর ভালোবাসা দিয়ে লিখতে পারে, তার উত্তম উদাহরণ চিঠির প্রতিটি লাইন। একজন ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহকে যিনি ‘ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ’ হিশেবে গড়ে তুলেছেন, তিনিই যে এমন ব্যবহার, এমন শ্রদ্ধা, সম্মান আর ভক্তি পাবেন, তা অনুমেয়। আপনার পরিচর্যাই আপনার সন্তান প্রতিদান হিশেবে আপনাকে ফেরত দেবে। তার মাঝে প্রতিবিম্বিত হবেন আপনি, যেভাবে চিঠির লাইনে লাইনে ইবনে তাইমিয়্যাহ প্রতিবিম্বত করে গেছেন তারঁ মা’কে।

ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ’র আম্মাজান প্রতিদিন শেষরাতে উঠে আগে ছেলেকে জাগিয়ে দিতেন তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য। তাহাজ্জুদের সময় শেষ হয়ে যখন ফযরের আযান শোনা যেতো, তখন তিনি পুত্র আহমাদ ইবন হাম্বলকে মসজিদের অনেকদূর পর্যন্ত পথ আগিয়ে দিতেন, কারণ তখনও চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকতো। এমন নিবিড় পরিচর্যাকারিনীর সন্তান হয়ে উঠলেন যুগশ্রেষ্ঠ ইমাম! সন্তানকে যে তারবিয়্যাহ তারা দিতেন, তা একদিন মহীরুহ হয়ে আকাশ ছুঁতো।

[ঘ]

আমাদের সন্তানেরা হলো আমাদের আয়না। আমরা তাদের মাঝেই প্রতিবিম্বিত হবো। তারা আমাদের স্বপ্নের বীজ, যে বীজ থেকে সুখের মহীরূহ আকাশ পানে মাথা তুলে দাঁড়াবে। তারা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ, যে সম্পদের সুফল আমরা আখিরাতেও ভোগ করবো। তারা হয়ে উঠবে আমাদের জন্য সাদকায়ে জারিয়া। যখন আমরা বেঁচে থাকবো না, তখন নিশুঁতি রাতগুলোতে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে তারা বলবে- ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা-ইয়ানি সগীরা’। ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার পিতা-মাতার প্রতি আপনি ঠিক সেভাবে দয়া করুন যেভাবে তারা আমাকে আমার শৈশবে দয়া, মায়া-মমতা দিয়ে বড় করেছেন’। সত্যিকারের এমন মহীরূহ পেতে হলে সন্তানের হৃদয়-মননে এখন থেকেই বীজ বুনে যেতে হবে। স্বপ্ন সুখের বীজ।

আপনার গুহাটা খুঁজে নিন

সূরা আল কাহাফে বেশ অনেকগুলো ঘটনার পরম্পরা আমরা দেখতে পাই। তবে, মুসা আলাইহিস সালামের মতো প্রসিদ্ধ নবি এবং খিযির আলাইহিস সালামের মতো প্রসিদ্ধ ব্যক্তির ঘটনা এই সূরায় থাকলেও, সূরাটা শুরু হয়েছে কতিপয় যুবকদের দ্বীনে অটল-অবিচল থাকবার ঘটনা দিয়েই।

কোন এক সুপ্রাচীন সময়ে, একটা অঞ্চলের সবাই যখন তাওহিদের রাস্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়লো, যখন তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে হরেক রকমের উপাস্যকে ডাকতে শুরু করলো, তখনও কিছু যুবক নিজেদের ঈমান-আমলকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়। যখন ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে গোটা জনপদ, তখনও তারা স্রোতে মিশে না গিয়ে, নিজেদেরকে ধরে রাখতে পেরেছিলো একত্ববাদের বলয়ে।

কিন্তু, যুবকদলের জন্য ব্যাপারটা মোটেও সহজ ছিলো না। তারা জানতো— তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে এক ঘোর বিপদ। তাদের বিশ্বাসের কথা, সঠিক ধর্মে তাদের নিবিষ্ট থাকবার ঘটনা যদি জানাজানি হয়ে যায়, যদি তা জনপদের হর্তাকর্তাদের কানে পৌঁছে, তাহলেই তাদের জীবন সংশয়ে পড়ে যাবে। তাদের নিশ্চিহ্ন করা হবে চিরতরে।

জীবন এবং ঈমান রক্ষার এমন দূর্বোধ্য দো’টানায় পড়ে যুবকদল একত্র হলো একটা গুহার মধ্যে। সেখানে তারা আল্লাহর কাছে করজোড়ে দুয়া করলো। হৃদয়ের সকল আকুতি, সকল মিনতি সহকারে তারা আল্লাহকে বললো,

‘হে আমাদের পালনকর্তা! আপনার অবারিত রহমত থেকে আমাদের রহমত দান করুন, এবং আমাদের কাজটাকে সঠিকভাবে সম্পূর্ণ করে দিন’- সূরা আল-কাহাফ, আয়াত- ১০

যে ঘোরতর বিপদের মুখে তারা দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে তাদের বাঁচাবার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নেই। এই দৃঢ় বিশ্বাস তাদের অন্তরে বদ্ধমূল ছিলো বলেই তারা সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায় সাহায্য চেয়ে হাত উঠাতে পেরেছিলো।

চরম দুঃসময়ে, যখন চারদিকে অন্ধকার ছাড়া আর কোনকিছুই দৃশ্যমান নয়, যখন শত্রুর নিঃশ্বাস একেবারে ঘাঁড়ের ওপরে, যখন দ্বীনের ওপর অটল থাকাটা জীবন-মরণের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়— এমন অবস্থাতেও এক আল্লাহর ওপর ঈমান ধরে রেখে, দুনিয়ার কারো কাছে ধর্ণা না দিয়ে, কারো মতের সাথে ‘কম্প্রোমাইজ’ না করে কেবলমাত্র আল্লাহর ওপরেই ভরসা রাখতে পারাটা নিঃসন্দেহে খুবই উঁচু স্তরের তাওয়াক্কুলের পরিচয় বহন করে। তাওয়াক্কুলের এমন স্তরে উন্নীত হতে পেরেছিলো বলেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা তাদের দুয়া কবুল করেছিলেন। তাদেরকে দয়া করেছিলেন এবং হেফাযত করেছিলেন তাদের ঈমান।

তিনি তাদের এক সুদীর্ঘকালের জন্য ঘুম পাড়িয়ে দেন। যখন তাদের ঘুম ভাঙলো, তারা অবাক বিস্ময়ে জানতে পারে— যে অত্যাচারী সম্প্রদায়ের হাত থেকে বাঁচতে তারা একদা গুহায় ঢুকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছিলো, সেই অত্যাচারী সম্প্রদায় বহু আগেই গত হয়েছে! দুনিয়ায় আর তাদের কোন চিহ্নই অবশিষ্ট নেই! ঈমান থেকে বিচ্যুত না হওয়ায় একদা যেভাবে তাদের প্রাণ নাশের আশংকা দেখা দিয়েছিলো, সেই দুঃসময় এক ঝটিকা স্বপ্নের ভেতরেই অন্তর্হিত হয়েছে।

এই যুবকদলের ঘটনা কেনোই-বা সূরা কাহাফে আসবে, তা-ও আবার একেবারে শুরুতে? কেনো প্রতি জুমা’বারে সূরা কাহাফ তিলাওয়াতের জন্য নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভীষণভাবে জোর দিয়েছেন?

কারণ, যুবকদল এখনও আমাদের জীবনে ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক।

দ্বীন পালন করতে গিয়ে এখনও আমরা অনেক সমস্যার মুখোমুখি হই। চারপাশের এতো এতো বক্রতা, এতো বিদ্বেষ, এতো ভুল আর ভ্রান্তির ভেতর মাঝে মাঝে আমরা সত্যিই হাঁপিয়ে উঠি। মনে হয়— এই বুঝি হাল ছেড়ে দিতে হবে! এই বুঝি আর পারলাম না!

দাঁড়ি রাখতে গিয়ে ছেলেটা ক্যাম্পাসে জঙ্গি ট্যাগ খেলো। তাকে বলা হলো মৌলবাদী! ভয় আর ঘৃণায় সহপাঠীরা তার সাথে মিশতে চায় না।

যে মেয়েটা পর্দা আর হিজাবে আবৃত করে নিলো নিজেকে, ডিপার্টমেন্টের ভাইবা বোর্ডে তাকে করা হলো ভীষণরকম নাজেহাল! পশ্চাদপদ, ক্ষ্যাত সহ নানাবিধ তকমা এঁটে দেওয়া হলো তার গায়ে।

ঘুষের বিনিময়ে যে সৎ অফিসারটা এক দূর্নীতিবাজের কার্যসিদ্ধিতে সহযোগি হলো না, উপরের তলায় লবিং করে তাকে ছাটাই করে দেওয়া হলো রাতারাতি, কিংবা বদলি করে দেওয়া হলো অন্যত্র।

যে মা তার সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে দেওয়ার বদলে হিফয-খানায় ভর্তি করিয়েছে, যে মেয়েটাকে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সকালে গান শেখানোর বদলে কুরআন শেখাচ্ছেন এক মা— তার জা, তার ননদ কিংবা প্রতিবেশিনীদের কাছে তিনি খুবই আহাম্মক ধরণের মহিলা! সামাজিক কোন অনুষ্ঠানে তিনি একপ্রকার অবাঞ্চিত!

এতো গেলো বাইরের বাঁধার সাতকাহন। নিজের ভেতর থেকেও কি কম বাঁধার মুখোমুখি আমরা হই?

নিজের নফসের বিরুদ্ধে যে অনবরত সংগ্রামে লিপ্ত আমরা, পাপের দুনিয়ায় আমাদের যে বারংবার অনুপ্রবেশ, তা-ও কী বাইরের বাঁধার চাইতে কোনোদিকে কম?

অবশ্যই না। নিজের নফসের কাছে যেভাবে আমরা বারংবার পরাজিত হই, যেভাবে শয়তান রোজ আমাদের দাবার গুটি বানিয়ে খেলে, তাতে বাইরের বাঁধার চাইতে ভিতরের বাঁধা আরো বেশি ভয়ানক, আরো বেশি অনতিক্রম্য আমাদের জন্য। বাইরের বাঁধাকে তা-ও তো ধৈর্য ধরে উপেক্ষা করা যায়, কিন্তু ভিতরের বাঁধাকে আটকাতে যে সংযমের দরকার পড়ে— তা আমাদের অর্জন হলো কই?

দ্বীন পালনে এমন বিভিন্ন বাঁধা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে ঘুরেফিরেই আসে। মাঝে মাঝে আমরা এসবে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়ি। হাল ছেড়ে দিই কিংবা ধুঁকতে থাকি।

কিন্তু, যদি আমরা আসহাবে কাহাফের সেই যুবকদের মতোন একটা গুহা খুঁজে নিতে পারি, যে গুহায় আমরা কাকুতি-মিনতি করে কেবল আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবো, যে গুহায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আল্লাহকে বলবো,

‘পরওয়ারদেগার! দ্বীন পালন করতে গিয়ে আজ তাদের কাছে আমি উপেক্ষিত। তারা আমাকে এড়িয়ে চলে। আপনি তো উত্তম বন্ধু আমাদের। এদের চাইতে উত্তম সঙ্গী আপনি আমাকে জুটিয়ে দিন’।

‘হে আমার রব! আপনার সন্তুষ্টির তাগিদেই আমি নিজেকে হিজাবে আবৃত করেছি। ওদের অপবাদের দুঃখ আপনি ছাড়া আর কে আছে আমার যার সমীপে আমি তুলে ধরবো?’

‘মাবুদ! আপনাকে ভালোবেসে ঘুষের মতো হারাম থেকে নিজেকে দূরে রেখেছি। আজ তারা আমাকে দূর্দশায় ফেললো। কিন্তু, উত্তম বিনিময় তো অবশ্যই আপনার কাছে। আপনিই আমার উত্তম বিনিময়দাতা’।

ভাবছেন, দ্বীনে অটল অবিচল থাকার তাগিদে, আল্লাহর কাছে এভাবে চাইতে হলে কোন গুহায় গিয়ে ঠাঁই নেবেন, তাই তো?

আমি খোঁজ দিচ্ছি। আপনার ঘরের কোণে, যে নিভৃত জায়গাটা আছে, মাঝরাতে সেখানটায় জায়নামাজটা পাতুন, এরপর দাঁড়িয়ে যান আল্লাহর সামনে। খুলে বলুন আপনার মনের সকল বাসনা, সকল দুঃখ-কষ্ট যা আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। আপনার সকল অপ্রাপ্তি, সকল মন খারাপের গল্প তাঁর সাথেই করে ফেলুন। দেখবেন, আসহাবে কাহাফের ওই যুবকদের মতোন তিনি ঠিক-ই আপনার জন্য একটা রাস্তা বের করে দেবেন যাতে করে আপনি আপনার সমস্যাকে সবরের সাথে উতরে যেতে পারবেন।ভেঙে পড়বেন না। কেবল, আপনার গুহাটা খুঁজে নিন।

ভালবাসা দিবস উপলক্ষে সকল প্রকার অনুষ্ঠান করা হারাম

ভালবাসা দিবস উপলক্ষে সকল প্রকার অনুষ্ঠান করা হারাম

– সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের ফতোয়া

▬▬▬▬◈♡◈▬▬▬▬

সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদে বিশ্লেষণের পর এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে, কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট প্রমাণাদি দ্বারা এ কথা অকাট্য ভাবে প্রমাণিত যে, ইসলামে ঈদ বা উৎসবের দিন মাত্র দুটি। সালাফে সালেহীনগণও এ বিষয়ে একমত হয়েছেন। ইসলামে স্বীকৃত ঈদ দুটির একটি হল ঈদুল ফিতর, অপরটি হল ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদ।

উল্লিখিত ঈদ দুটি ব্যতীত যত ঈদ বা উৎসব আছে, হোক না তা কোন ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত বা কোন গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত বা কোন ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত তা বিদআত। মুসলমানদের তা পালন করা বা পালন করতে বলা বৈধ নয় এবং এ উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করা ও এ ব্যাপারে কিছু দিয়ে সাহায্য করাও নিষেধ। কেননা এ ধরণের কাজ আল্লাহ তা’আলার সীমা লঙ্ঘন বৈ অন্য কিছু হবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করবে সে নিজের উপর অত্যাচার করবে।

এ ধরণের কালচার বিধর্মীদের অনুসরণের কল্পে গ্রহণ করা হলে অপরাধ আরও মারাত্মক হবে। কারণ এর মাধ্যমে তাদের সদৃশ্যতা গ্রহণ করা এবং তাদেরকে এক ধরণের বন্ধু বানানো হয়। অথচ আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে এ থেকে বারণ করেছেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

من تشبه بقوم فهو منهم “যে ব্যক্তি কোনও সম্প্রদায়ের সাথে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করল সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য। ভালবাসা দিবস পালন করাও এ নিষেধের অন্তর্ভুক্ত। কেননা এটি খৃষ্টানদের উৎসব। যে মুসলমান আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে তার জন্য এ কাজ করা বা এই দিনে কাউকে ফুল বা অন্যকোনো উপহার দেয়া বৈধ নয়। বরং তার কর্তব্য হল আল্লাহ এবং তার রাসূলের হুকুম পালন করা এবং আল্লাহর শাস্তি ও গযব আসে এমন কাজ থেকে নিজে দূরে থাকা ও অন্যদের দূরে রাখা।অতএব এ দিবসকে কেন্দ্র করে পানাহার করা, ক্রয়-বিক্রয় করা, কোন কিছু প্রস্তুত করা বা উপঢৌকন দেয়া, চিঠি-পত্র চালাচালি করা ও প্রচার-পত্র বিলি করা অবৈধ।

এ সমস্ত কাজের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করা হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন,وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَاب“সৎকর্ম ও আল্লাহ ভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না।” (সূরা মায়িদাহ: ২)

▬▬▬▬◈♡◈▬▬▬▬

সৌদি আরবের গবেষণা ও ফতোয়া প্রদান বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্যবৃন্দ:

১) চেয়ারম্যান: আব্দুল আযিয বিন আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মাদ আলে শেখ

২)সদস্য: সালেহ বিন ফাওজান আল-ফাওজান

৩) সদস্য: আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহমান আল-গুদাইয়ান

৪) সদস্য: বকর বিন আব্দুল্লাহ আবু জায়েদ

[ফতোয়া নং ২১২০৩ তারিখঃ ২৩-১১- ১৪২০ হি.]