আমরা রমাদানকে কিভাবে স্বাগত জানাতে পারি

আমরা রমাদানকে কিভাবে স্বাগত জানাতে পারি?

প্রশ্ন: শরিয়ত অনুমোদিত এমন কিছু বিশেষ বিষয় কি আছে যা দিয়ে একজন মুসলিম রমযানকে স্বাগত জানাতে পারে?

উত্তর:

আলহামদুলিল্লাহ।.

মাহে রমযান বছরের সবচেয়ে উত্তম মাস। কেননা আল্লাহ্‌ তাআলা এ মাসে সিয়ামকে ফরয করে, ইসলামের চতুর্থ রুকন বানিয়ে এ মাসকে বিশেষত্ব দিয়েছেন। এ মাসের রাতে কিয়াম পালন করার বিধান জারী করেছেন। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর নির্মিত: এই সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ্‌ ছাড়া সত্য কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহ্‌র রাসূল (বার্তাবাহক), নামায প্রতিষ্ঠা করা, যাকাত প্রদান করা, রমযানের রোযা রাখা এবং বায়তুল্লাহ্‌র হজ্জ আদায় করা।”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবপ্রাপ্তির আশায় রমযান মাসে কিয়াম পালন করবে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।”[সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিম]

রমযান মাসকে স্বাগত জানানোর জন্য বিশেষ কিছু আছে মর্মে আমি জানি না। তবে একজন মুসলিম রমযানকে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সাথে, আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে এবং আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সাথে গ্রহণ করবে; যেহেতু তিনি তাকে রমযান পর্যন্ত পৌঁছিয়েছেন, তাওফিকপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন এবং জীবিতদের মধ্যে রেখেছেন যারা নেক আমলের ক্ষেত্রে পরস্পর প্রতিযোগিতা করে। যেহেতু রমযানে উপনীত হতে পারা আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে একটি মহান নেয়ামত। এ কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে রমযান আগমনের সুসংবাদ দিতেন রমযানের মর্যাদা তুলে ধরার মাধ্যমে এবং আল্লাহ্‌ তাআলা রোযাদার ও নামাযগুজারদের জন্য যে মহান সওয়াব প্রস্তুত রেখেছেন তা বর্ণনা করার মাধ্যমে। শরিয়ত একজন মুসলিমের জন্য অনুমোদন করে যে, তিনি এই মহান মাসটিকে স্বাগত জানাবেন খালিস তাওবার মাধ্যমে, সিয়াম ও কিয়ামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করার মাধ্যমে, নেক নিয়ত ও দৃঢ় সংকল্পের সাথে।”[সমাপ্ত]

ফাদিলাতুশ শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায এর “মাজমুউ ফাতাওয়া ওয়া মাকালাত মুতানাওয়্যিয়া”

একই মৃত্যু— অথচ কী ভিন্ন তার রেখাপাত!

[১]

বাংলা ভাষার বেশকিছু শব্দের জঘন্য রকমের বিকৃতি ঘটেছে। সেরকম দুটো শব্দ হলো— দালাল এবং ঘটক। কোনো একটা কাজে যে বা যিনি মধ্যস্থতা করে থাকেন তাকেই দালাল বলা হয়। কিন্তু দূর্ভাগ্য শব্দটার! দালালের অর্থ এখন হয়ে গেছে চাটুকারিতা, তোষামেদি, পদলেহন ইত্যাদি। অর্থাৎ,  নিজের স্বার্থ বজায় রাখতে বা টিকিয়ে রাখতে যে অন্যের চাটুকারিতা করে বেড়ায় তাকে আমরা দালাল বলি। কী সুন্দর একটা শব্দের কী এক জঘন্য পরিণতি!

এরকম আরেকটি শোচনীয় পরিণতি বরণ করেছে ‘ঘটক’ শব্দটি। অবশ্য, দালাল শব্দের মতোন অতোটা পোড়াকপাল তার নয়। ঘটক সেই ব্যক্তি যিনি একটা বিয়েতে বরপক্ষ এবং কনেপক্ষের মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। খুবই ভালো এবং নামদার একটা পেশা বটে!  অথচ, অদৃশ্যমান হলেও শব্দটার সাথে জড়িয়ে গেছে কিছু অপ্রিয় ব্যাপার-স্যাপার।

কিছু কদর্য ব্যক্তির বাড়াবাড়ি রকম আচরণে ঘটক শব্দ শুনলেই আমাদের মানসপটে ভেসে উঠে এমন এক চরিত্র, যিনি বেশি কথা বলেন, যিনি যা বলে থাকেন তার অধিকাংশই মিথ্যা, যিনি সবসময় বাড়িয়ে বলেন এবং দিনশেষে এসবের পেছনে তার রয়েছে একটা মোটা স্বার্থ৷ স্বার্থটা কী? সেটা হলো— কোনোমতে বিয়েটা ঘটিয়ে দিতে পারলেই কেল্লাফতে! একটা হাজার টাকার ব্যবসা! এই দুটো শব্দের এহেন জঘন্য পরিণতির জন্য শেষপর্যন্ত যে জীবটি দায়ী তার নাম মানুষ!

সম্প্রতি একটা ‘সফল ঘটকালি’ সম্পন্ন করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার, আলহামদুলিল্লাহ।  কনে আমার স্ত্রীর বান্ধবি আর বর আমার বন্ধু মানুষ। দুজনের মধ্যে মেলবন্ধনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাকে মধ্যস্থতাকারী বানিয়েছেন। তাই, প্রসঙ্গক্রমে যখনই কেউ পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘উনিই হচ্ছেন এই বিয়ের ঘটক’, তখন ভারি লজ্জা লাগে। মন উসখুস করে। কী একটা বিশ্রী কান্ড! ভাবি— আমিই ঘটক এই কথা শোনার পর মানুষগুলো আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে? ভাবছে আমি একটা মিথ্যের জাহাজ? ভারি ভারি মিথ্যে কথা আর সাত-পাঁচ বুঝিয়ে দু’পক্ষের মাথা খেয়েছি? টাকার লোভে তাদের আমি আকাশ-পাতাল বুঝিয়েছি? লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়!

ইচ্ছে করে বাংলা অভিধান থেকে ‘ঘটক’ শব্দটাকেই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিই। কিন্তু, ও কাজ তো আমার দ্বারা সম্ভব না। আমি তো বাংলা ভাষার হর্তাকর্তাদের কেউ নই। আমি যা পারি তা হলো এই শখের ঘটকালি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। তাই ইচ্ছে।

[২]


শখের ঘটকালি করে ফেললাম, অথচ চূড়ান্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবো না, তা বোধকরি ভালো ঠেকে না। একে তো বর আমার বন্ধু মানুষ, কনে আমার প্রিয়তমার প্রিয়তম বান্ধবি। তার উপরে আমিই ঘটক। এমন ত্রিশৈল চক্রে বাঁধা পড়ে বিবাহ অনুষ্ঠানে আমাকে আসতেই হলো। ইট-পাথর আর দূষিত বাতাসের শহর ঢাকা ছেড়ে নির্ঝঞ্ঝাট, সবুজ-শ্যামলিমা আর ছায়াঢাকা কুষ্টিয়ার পথে বিয়ের বর সমেৎ রওনা করতে হলো ট্রেনে। ঢাকা টু খুলনার ট্রেন। আমরা নেমে যাবো ভেড়ামারা ষ্টেশানে। পথিমধ্যে অতিক্রম করতে হলো সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ষ্টেশান। ওই ষ্টেশানে আমাদের ট্রেন থামতেই আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ করে চ্যাঁৎ করে উঠলো।

নাহ, এই ষ্টেশান ঘিরে আমার কোন সুখস্মৃতি নেই, তবে শোকস্মৃতি আছে। এই তো কয়েকদিন আগের ঘটনা। সপ্তাহও তো হলো না৷ এই এলাকাতেই কী করুণ একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেলো! মাইক্রো করে বরসহ বরযাত্রী যাচ্ছিলো। ট্রেনের সাথে ধাক্কা লেগে মূহুর্তে ঝরে গেলো কতোগুলো প্রাণ! মারা গেলো বিয়ের বরটাও। আহারে! স্বপ্ন শুরুর আগেই স্বপ্নভঙ্গ!  সূর্যোদয়ের আগেই যেন জীবনে নেমে এলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত সূর্যাস্ত। মৃত্যু কতো সহজ! কতো নিকট!

ভাবছিলাম— আমিও তো বরযাত্রী যাচ্ছি। আমার সাথেও তো এক বর বসে আছে। তার চোখেমুখে স্বপ্নের মাখামাখি। তিনি ভাসছেন এক স্বপ্নের নদীতে। সেই নদীতে ছলাৎ ছলাৎ করে উপচে পড়ছে সুখের ঢেউ। সেই ঢেউয়ে ভারি উথলা তার মন। ঢেউয়ের পরতে পরতে স্বপ্নের গাঁথুনি। বাতাসে সুখের ঝনঝনানি।


আচ্ছা, যদি আজ আমাদের সাথেও ঘটে যায় সেদিনকার মতোন কোন ঘটনা? যদি কোন দূর্ঘটনায় স্বপ্নভঙ্গ হয় সকলের? যদি শোনা যায় বগিচ্যুত হয়ে পড়েছে আমাদের ট্রেন? যদি চিৎকার-চেঁচামেচিতে আজও ভরে উঠে উল্লাপাড়ার আকাশ? যদি মৃত্যু হয় বরের? যদি মৃত্যু হয় আমার? হতেও তো পারে! এই জগত সংসারের কোনটাই তো মানুষের ইচ্ছের দামে হয় না। যিনি এই জগত সংসারের মালিক, তার ইচ্ছেই তো সব, তাহলে?

আমি কি প্রস্তুত আছি মৃত্যুর জন্যে? সেদিনকার ওই বর কি প্রস্তুত ছিলো? আত্মভোলা এই দেহের উপর যদি মৃত্যু এসে ভর করে? তাহলে কি হবে? নিতান্তই অপ্রস্তুত হয়ে ঢুকে পড়বো এক মহা সমাবেশে? কীসের উপর আমার মৃত্যু হচ্ছে? হাসি-কৌতুক আর ঠাট্টা-তামাশার উপর? গান-বাজনা আর নাফরমানির উপর? অকৃতজ্ঞতা-অবাধ্যতার উপর? সে এক মহাভাবনা!

[৩]

মারা গেছেন হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ। তিনি মারা যাওয়ার সাথে সাথে একটা জিনিস চাউর হয়েছে। গুলশান মদের বারে তার মৃত্যু শোকে আধ ঘন্টার জন্য মদ পান বন্ধ রাখা হয়েছে। হায় কপাল! কী এক মৃত্যু আর তার প্রতি কী এক নিবেদন!

কুষ্টিয়া এসে জানলাম এখান থেকে ঝিনাইদহ একেবারে কাছে। এতো কাছে এলাম, অথচ স্যার খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহর স্মৃতি বিজড়িত আস-সুন্নাহ ট্রাস্ট দেখবোনা, তা কী করে হয়? এমন সুযোগ হাতছাড়া করি কোন দুঃখে?


বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেই রওনা করলাম ঝিনাইদহ আস-সুন্নাহ ট্রাস্টে। আমার স্যারের নিজের হাতে গড়া ইমারত! আহা, সেই দেওয়াল, সেই মাদ্রাসা, সেই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো! সবকিছুই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু নেই সেই মানুষটা! তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম খানিকক্ষণ।  ভাবলাম— শতধা বিভক্ত এই উম্মতকে এক করতে চাওয়া মানুষটা যদি দেখতেন এই উম্মত আরো সহস্র, অযুত-নিযুত দলে ভাগ হয়ে গেছে, তিনি কি আপসোসটাই না করতেন!

এরশাদের মৃত্যুর সংবাদে মদের বারে আধ ঘন্টার জন্য মদ পান বন্ধ ছিলো। আর, স্যার খন্দকার আবদুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে ভগ্ন হৃদয়ে তার জন্য দোয়া করেনি, হাত তুলে তার মাগফিরাত কামনা করেনি, তাহাজ্জুদে তার নাযাত কামনা করেনি এমন দরদী মুসলমান এই তল্লাটে বিরল হবে। দুটোই মৃত্যু— অথচ মানবহৃদয়ে কী ভিন্ন তার রেখাপাত! 

পইপই করে হিশেব রাখার দিনে

[১]

পইপই করে হিশেব রাখবার একটা চমৎকার সুযোগ এসেছিলো আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সামনে।

দূর সম্পর্কের এক দরিদ্র আত্মীয়কে আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। দারিদ্র‍্যের ভারে নুইয়ে পড়া তার জীবনের অচলাবস্থায় আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন সাহায্যের অন্যতম ভরসাস্থল। কিন্তু, যেবার ‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ব্যাপারে মদীনার মুনাফিকেরা কুৎসা রটালো, চারিত্রিক কালেমার যে অপবাদ তারা লেপ্টে দিতে চেয়েছিলো উম্মুল মুমিনীনের গায়ে, সেই ঘটনায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলো আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেই আত্মীয়ও।

ভাবুন তো— কারো দুঃখের দিনে আপনি আপনার সর্বোচ্চটা দিয়ে তার পাশে দাঁড়ান, কিন্তু দিনশেষে যদি জানতে পারেন যে সেই লোকটা আপনার মান-ইজ্জতকে দুই পয়সার দাম দেয় না, সুযোগ পেলে আপনার পিঠেও ছুরি চালাতে মরিয়া, আপনার অবস্থা তখন কেমন হবে? আপনি নিশ্চয় অনেক দুঃখ পাবেন। ভাববেন খাল কেটে আপনি হয়তো কুমির আমদানি করেছেন এতোদিন। অথবা, দুধ-কলা দিয়ে পুষে এসেছেন বিষধর কালসাপ। যার জন্য আপনি গলা-পানিতে নামতে রাজি, সে যদি ওই পানিতেই আপনাকে ডুবিয়ে মারতে চায়, আপনার মনোবস্থা তখন কীরুপ হবে? আপনি বলবেন— না! তোমার সাথে আর না। তোমাকে আমার চেনা হয়ে গেছে।

তাকে এতোদিন যা সাহায্য-সহযোগিতা আপনি করতেন, সব বন্ধ করে দিবেন মুহূর্তেই। আর যাই হোক— একজন বিশ্বাসঘাতকের সাথে আর কোন সম্পর্ক আপনি রাখতে পারেন না।

‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঘটনায় দূর সম্পর্কের সেই আত্মীয়ের ব্যাপারেও মুহূর্তের জন্য এভাবে ভেবেছিলেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি বললেন— ‘নিয়মিতভাবে তোমাকে যে সাহায্য-সহযোগিতা আমি করতাম সেটা আজ থেকে বন্ধ করলাম। আমার কন্যার ব্যাপারে যে লোক এতোটা অপবাদ দিতে পারে, তার জন্য আমার কোন দয়া থাকতে পারে না’।

একজন মানুষ হিশেবে, একজন বাবা হিশেবে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই চিন্তাটা খুব-ই স্বাভাবিক। আপনি বা আমি হলেও এর ব্যতিক্রম চিন্তা কখনোই করতে পারতাম না। কিন্তু আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এই চিন্তাটা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পছন্দ করলেন না। কেউ একজন অন্যায় করেছে বলে, সেই অন্যায়ের পই পই হিশেব করে, তার সাথে যাবতীয় সম্পর্ক আপনি ছিন্ন করে আসবেন, দুঃসময়ে তাকে দিয়ে আসা সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করে দিবেন— এমনটা করবার ব্যাপারে ইসলাম আপনাকে উৎসাহিত করে না। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর এমন সিদ্ধান্তের বিপরীতে, তাকে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা কুরআনে আয়াত নাযিল করলেন:

‘তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী তারা যেন শপথ না করে যে, তারা আত্মীয়-স্বজন, মিসকীন এবং আল্লাহর পথে হিজরাতকারীদেরকে সাহায্য করবে না। তারা যেন তাদেরকে ক্ষমা করে ও তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি উপেক্ষা করে। তোমরা কি পছন্দ কর না যে, আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিক? আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু।’– আন নূর, আয়াত-২২

আল্লাহ বলছেন— আমাদের মধ্যে যাদের মর্যাদা এবং প্রাচুর্য আছে, আমরা যেন কখনোই আমাদের আত্মীয়স্বজন, দরিদ্র এবং আল্লাহর রাস্তায় হিজরতকারী, আমাদের সাহায্য যাদের অতীব দরকার তাদের যেন আমরা উপেক্ষা না করি। হতে পারে আমাদের কোন বিপদের সময়ে তারা আমাদের পাশে ছিলো না। হতে পারে তাদের জন্যই আমাদের পার করতে হয়েছে কোন ভয়ঙ্কর দুঃসময়। হতে পারে আমাদের সাথে তারা ভারী অন্যায়-অবিচার করেছে কোন সময়। একদিন তাদের কাছে হাত পাতলেও তারা হয়তো আমাদের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আল্লাহ বলছেন— তাদের সেই অন্যায়ের, তাদের সেই অবিচারের, সেই আত্মকেন্দ্রিকতা এবং হিংসুটে মনোভাবের পইপই হিশেব যেন আমরা করে না রাখি। সেগুলোকে হৃদয়ে টুকে রেখে তাদের দুঃসময়ে যেন আমরা প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে না উঠি। আমরা যেন তাদের ক্ষমা করি। তাদের ভুলকে ভুলে গিয়ে, আমাদের দয়া, উদারতা আর প্রশস্ত হৃদয় তাদের যেন তাদের প্রতি নিবেদন করি। এতে কী হবে? আল্লাহ বলছেন— ‘তোমরা কি চাও না আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দিক?’

যখন একজনের ভুলকে বড় করে না দেখে তার দুয়ারে দয়ার ঝুঁড়ি নিয়ে উপস্থিত হবো, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালাও তার দয়ার ভাণ্ডার আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে দিবেন। যে ক্ষমা করতে পারে তার কোন ক্ষতি নেই, বরং তার জন্য আছে মহা-পুরস্কার।

আয়াতটা নাযিল হওয়ার পর আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের ভুলটা উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি বললেন— ‘অবশ্যই আমি চাই যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাকে ক্ষমা করুন। আমি কখনোই আমার ওই আত্মীয়কে দিয়ে আসা সাহায্য-সহযোগিতা বন্ধ করবো না’।

আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু পইপই করে হিশেব রাখেননি।

[২]

পইপই করে হিশেব যদি রাখতেই হতো, এই কাজে ইউসুফ আলাইহিস সালামের চাইতে বেশি অগ্রাধিকার আর কে পেতেন দুনিয়ায়?

সেই ছোট্টবেলায় খেলার নাম করে ভাইয়েরা তাঁকে কূপে ফেলে দিয়েছিলো। এরপর জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কতো দুঃসময়ের ভেতর দিয়েই না যেতে হয়েছিলো তাঁকে! কিন্তু, একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যখন তাঁকে রাজত্ব দান করলেন, দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করলেন ক্ষমতা দিয়ে, যখন ভাইদের অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়ার সমস্ত সুযোগ ইউসুফ আলাইহিস সালামের পায়ে লুটোপুটি খেতে লাগলো, তখন ভাইদের উদ্দেশ্য করে তিনি কী বললেন জানেন?

‘আজ তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ যেন তোমাদের ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল’– সুরা ইউসুফ, আয়াত-৯২

পইপই করে হিশেব রাখেননি নবি ইউসুফ আলাইহিস সালাম।

[৩]

একদিন ‘আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন কোনটা?’

নবিজী বললেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন ছিলো সেটা, যেদিন তায়েফবাসীরা আমার প্রতি নির্দয় হয়েছিলো’।

মক্কাবাসীর অনবরত অনাচার-অত্যাচার আর প্রিয়তম চাচা আবু তালিব এবং প্রিয়তম স্ত্রী খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান নবিজী তায়েফে গিয়েছিলেন একবুক আশা নিয়ে। তিনি ভেবেছিলেন— তায়েফবাসীরা মক্কাবাসীর মতো নির্দয় হবে না। হয়তো আল্লাহর দ্বীনকে তারা পরম মমতায় গ্রহণ করবে। কিন্তু, তায়েফবাসীরা তা করেনি। উল্টো নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তারা এতো ঘৃণ্য আর জঘন্য পর্যায়ের অপমান করলো যে, তাকে রক্তাক্ত করে, পাথরের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করে বিতাড়িত করলো তায়েফ থেকে। সেই দিনটা ছিলো নবিজীর জীবনের সবচেয়ে বিষাদময় দিন।নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এমন অপমান দেখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পাহাড়ের ফেরেশতাকে আদেশ দিয়ে পাঠালেন। সেই ফেরেশতা এসে নবিজীকে বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া রাসুলাল্লাহ। আমি পাহাড়ে নিযুক্ত ফেরেশতা। তায়েফবাসীরা আপনার সাথে যা করলো তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা দেখেছেন। তিনি আমাকে আপনার কাছে আসবার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনি যদি চান তাহলে দুই পাহাড়ের চাপে আমি তায়েফবাসীকে পিষ্ট করে ফেলবো এখনই’।

এতো অত্যাচার, এতো নির্যাতন, এতো অপমান! তবু পাহাড়ের ফেরেশতার এই কথার জবাবে নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেদিন কী বললেন জানেন? তিনি বললেন, ‘না, আমি তা চাই না। আমি আশা করি একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা এই জনপদে এমন মানুষের আবির্ভাব ঘটাবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করবে’।

নবিজী সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পইপই করে হিশেব রাখেননি।

[৪]

কী পাচ্ছেন আর কী পাচ্ছেন না, কার কাছে পাচ্ছেন আর কার কাছে পাচ্ছেন না— এসব ভেবে যদি জীবন সাজাতে যান, তাহলে মানুষের ভুলগুলো বড় করে দেখা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর, মানুষের ভুলগুলো, ত্রুটি-অন্যায়গুলো যদি পইপই করে হিশেব করতে শুরু করেন, যদি আজ থেকে সেসব নোট করা শুরু করেন, সেই নোট খাতা একদিন এনসাইক্লোপিডিয়ার সমান হয়ে দাঁড়াবে। চারপাশে আপনি তখন শত্রু ছাড়া আর কিচ্ছু দেখতে পাবেন না। এমন সংকীর্ণ হৃদয় নিয়ে বাঁচবার জন্যে ইসলাম আপনাকে শেখায় না। ইসলাম আপনাকে উদার, মহৎ আর প্রশস্ত হৃদয় বানাতে শেখায়। কে কী দিলো, কে কী করলো— তার ওপর নির্ভর করে আপনি মানুষকে বিচার করবেন না। আপনি মানুষের কাজে লাগবেন, তাদের পাশে দাঁড়াবেন, তাদের বন্ধু হবেন বিনা শর্তে, বিনা-অভিপ্রায়ে।

উহু, ঠিক তা নয়।

অভিপ্রায় তো একটা আপনার থাকাই লাগবে। তো, কী সেটা, তাই তো? আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা বলছেন:

‘মানুষের কল্যাণ করুন যেভাবে আল্লাহ আপনার কল্যাণ করেন’।– আল ক্বাসাস, আয়াত-৭৭

কে আপনার অকল্যাণ সাধন করলো, কে আপনার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ালো না, কে আপনার পেছনে শত্রুতা করেছিলো— এসবকিছুর জন্যে আপনার জীবন কিন্তু থেমে থাকেনি। সেই অকল্যাণ থেকে, সেই দুঃসময় থেকে, সেই শত্রুতা থেকে কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনাকে ঠিক-ই উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। তাই, কারো উপকার করার জন্যে ‘সে আপনার জন্য কী করেছে’ তা বিবেচ্য নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আপনার জন্যে যা করেন তা-ই বিবেচ্য।

পইপই করে হিশেব রাখুন, তবে তা তাদের দুঃসময়ে তাদেরকে ঘায়েল করবার জন্যে নয়। মোনাজাতে আল্লাহর কাছে বলবার জন্যে যে—‘ইয়া আল্লাহ! আমার দুঃসময়ে আমি তাকে পাশে পাইনি, কিন্তু আপনি ঠিক-ই আমার পাশে ছিলেন। এখন তার দুঃসময়ে আপনি আমাকে তার মতো বানাবেন না। আমার অন্তরকে তার মতো সংকীর্ণ করে দিবেন না। তার বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাওফিক আপনি আমাকে দান করুন, ইয়া রব’।